আমিষ জাতীয় খাবার কি কি?
মানবদেহের গঠন ও বৃদ্ধির জন্য প্রোটিন বা আমিষ অপরিহার্য। আমাদের দেহের কোষ, পেশী, ত্বক, চুল, এমনকি রক্ত তৈরিতেও আমিষের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। শুধু তাই নয়, হরমোন, এনজাইম, অ্যান্টিবডি তৈরিতেও আমিষের প্রয়োজন হয়।
কিন্তু আমিষ জাতীয় খাবার কি কি? কোন খাবার গুলোতে আমিষের পরিমাণ বেশি থাকে? এই প্রশ্ন গুলোর উত্তর খুঁজে বের করার চেষ্টাই হলো এই আর্টিকেলের মূল লক্ষ্য। তো চলুন এবার তাহলে জেনে নেওয়া যাক, আমিষ জাতীয় খাবার কি কি।
আমিষ কত প্রকার ও কি কি?
আমাদের শরীরের সুস্থতা ও জীবনযাত্রার জন্য আমিষ অপরিহার্য। শরীরের গঠন, কোষ ও টিস্যু তৈরি, রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা শক্তিশালী করা, হরমোন ও এনজাইম তৈরির ক্ষেত্রে আমিষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আর এই আমিষকে প্রধানত দুইটি ভাগে ভাগ করা হয়। যেমন,
প্রাণীজ আমিষ
মাংস, মাছ, ডিম, দুধ, পনির - এই সুস্বাদু খাবার গুলোতে লুকিয়ে থাকে আমাদের শরীরের গঠনের জন্য অপরিহার্য আমিষ। আর এদের জৈব মূল্য বেশি, মানে এতে আমাদের শরীরে প্রয়োজনীয় সব ধরণের অ্যামিনো অ্যাসিড থাকে। যা শরীরে দ্রুত শোষিত হয় এবং পেশী গঠনে সাহায্য করে।
উদ্ভিজ্জ আমিষ
ডাল, বাদাম, মটরশুঁটি, ছোলা - এই সব সুস্বাদু খাবারেও আমিষ থাকে। তবে জৈবমূল্য তুলনামূলক কম লক্ষ্য করা যায়। মানে উক্ত খাবার গুলোতে কিছু কিছু অ্যামিনো অ্যাসিড থাকে না। তাই একসাথে বিভিন্ন উদ্ভিজ্জ আমিষ খেলে শরীরের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব।
আমিষ জাতীয় খাদ্যের কাজ কি?
আমরা যে খাবার খাই তার মধ্যে থাকা আমিষ ভেঙে আমাদের দেহে বিভিন্ন ধরণের আমিষ অ্যাসিড তৈরি করে। এই অ্যাসিড গুলো বিভিন্ন রকমের প্রোটিন তৈরি করে, যা আমাদের দেহের বিভিন্ন কাজ সম্পাদনে সাহায্য করে। চলুন এবার তাহলে আমিষ জাতীয় খাদ্যের কাজ কি তা জেনে নেওয়া যাক।
কোষের ভিত্তি
আমাদের দেহের প্রতিটি কোষের মূল উপাদান হলো প্রোটিন। আমিষ ভেঙে প্রোটিন তৈরি হয়, যা কোষের দেয়াল, কোষাণু, এনজাইম, হরমোন, রক্তের অংশ - সবকিছুরই মূল উপাদান। তাই শরীরের নতুন কোষ তৈরি, পুরনো কোষ মেরামত এবং টিস্যু পুনর্গঠনে আমিষ অপরিহার্য।
শক্তির উৎস
শর্করা ও চর্বির মতো, আমিষও শরীরে শক্তি সরবরাহ করে। প্রতি গ্রাম আমিষ আমাদের দেহকে ৪ ক্যালোরি শক্তি প্রদান করে। তবে, শক্তির প্রাথমিক উৎস হিসেবে আমিষ ব্যবহার করা হয় না। কারণ, আমিষের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে যা শক্তি সরবরাহের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা
আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে আমিষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমিষ এন্টিবডি তৈরিতে সাহায্য করে, যা বিভিন্ন রোগজীবাণু থেকে দেহকে রক্ষা করে। ত্বক, চুল, নখের সুস্থতা বজায় রাখতেও আমিষ অপরিহার্য।
হরমোন ও এনজাইম
শরীরে বিভিন্ন হরমোন ও এনজাইম তৈরিতে আমিষ ব্যবহৃত হয়। এই হরমোন ও এনজাইম বিভিন্ন শারীর বৃত্তীয় প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে। যেমন, হজম, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, থাইরয়েড হরমোন নিয়ন্ত্রণে আমিষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
আমিষ জাতীয় খাবার কি কি?
এতক্ষনের আলোচনা থেকে আমরা জানলাম আমিষ কত প্রকার ও আমিষের কাজ কি। তো এগুলো জানার পাশাপাশি আমাদের জানতে হবে আমিষ জাতীয় খাবার কি কি। আর যখন আপনি এই বিষয়টি জানতে পারবেন তখন আপনার আমিষ যুক্ত খাবার গুলো সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান থাকবে। আর আমাদের দৈনিন্দিন খাদ্যতালিকায় আমিষ জাতীয় খাবার কি কি তা নিচে শেয়ার করা হলো।
- মাছ: রুই, কাতলা, বেটি, ইলিশ, চিংড়ি, তিলাপিয়া ইত্যাদি।
- মাংস: গরুর মাংস, খাসির মাংস, মুরগির মাংস, হাঁসের মাংস ইত্যাদি।
- ডিম: মুরগির ডিম, হাঁসের ডিম ইত্যাদি।
- দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার: দুধ, দই, পনির, মাখন, ছানা, ক্ষীর ইত্যাদি।
- ডাল: মুগ ডাল, মসুর ডাল, ছোলা ডাল, কলাই ডাল, সবুজ ডাল ইত্যাদি।
- শস্য: গম, ধান, যব, বাজরা, ভুট্টা ইত্যাদি।
- বাদাম: কাজুবাদাম, পেস্তা বাদাম, চিনাবাদাম, বাদাম, আখরোট ইত্যাদি।
- বীজ: সয়াবিন, তিল, সূর্যমুখী বীজ, কুমড়া বীজ, খেসারী বীজ ইত্যাদি।
- শাকসবজি: সবুজ শাক, মটরশুঁটি, মুসুর ডালের শুঁটি, ব্রকলি, পালং শাক, ঢেঁড়স শাক ইত্যাদি।
আমিষ জাতীয় সবজি কোন গুলো?
আমাদের শরীরের সুস্থতা বজায় রাখার জন্য আমিষের ভূমিকা অপরিহার্য। মাংস, মাছ, ডিম, দুধ ইত্যাদি আমিষের প্রধান উৎস হিসেবে পরিচিত। কিন্তু শুধুমাত্র প্রাণীজ খাবার থেকেই আমিষ পাওয়া যায় না বরং সবজি থেকেও পর্যাপ্ত পরিমানে আমিষ পাওয়া সম্ভব। যেমন,
পালং শাক
শুধু সুস্বাদুই নয়, পালং শাক আমিষের একটি চমৎকার উৎসও বটে। প্রতি ১০০ গ্রাম পালং শাকে থাকে ২.৮ গ্রাম আমিষ, যা আমাদের দৈনিক চাহিদার প্রায় ১৪% পূরণ করে। এছাড়াও, এতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ, সি, ক্যালসিয়াম এবং আয়রন থাকে। তাই নিয়মিত পালং শাক খেলে শরীর প্রয়োজনীয় পুষ্টি পায়।
মেথি শাক
ঝাল ঝাল মেথি শাক শুধু সুস্বাদুই নয়, এতেও প্রচুর পরিমাণে আমিষ থাকে। প্রতি ১০০ গ্রাম মেথি শাকে থাকে ৩.১ গ্রাম আমিষ, যা আমাদের দৈনিক চাহিদার প্রায় ১৫% পূরণ করে। এছাড়াও, এতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার থাকে, যা হজমশক্তির জন্য উপকারী। তাই রান্নার সময় আপনার খাদ্যতালিকায় বেশি করে মেথি শাক রাখার চেস্টা করবেন।
শসা
শসা সাধারণত একটি ফল হিসেবে পরিচিত হলেও, এতেও কিছু পরিমাণে আমিষ থাকে। প্রতি ১০০ গ্রাম শসায় থাকে ১.৫ গ্রাম আমিষ থাকে, যা আমাদের দৈনিক চাহিদার প্রায় ৮% পূরণ করে। এছাড়াও, শসায় প্রচুর পরিমাণে জল এবং ভিটামিন সি থাকে। তাই গরমের দিনে শসা খেলে শরীর ঠান্ডা থাকে এবং ত্বকও ভালো থাকে।
ব্রকলি
ব্রকলি একটি জনপ্রিয় সবজি যা ভিটামিন, খনিজ এবং ফাইবার সমৃদ্ধ। আর ব্রকলিতেও যথেষ্ট পরিমাণে আমিষ থাকে। প্রতি ১০০ গ্রাম ব্রকলিতে থাকে ২.৮ গ্রাম আমিষ, যা আমাদের দৈনিক চাহিদার প্রায় ১৪% পূরণ করে। এছাড়াও, ব্রকলিতে থাকে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন কে, যা হাড়ের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। তাই নিয়মিত ব্রকলি খেলে শরীর প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করতে পারে।
আমিষের অভাব জনিত রোগ কি কি?
উপরের আলোচনা থেকে আমরা আমিষ জাতীয় খাবার কি কি তা জানলাম। তো আমাদের শরীরের সুস্থতা বজায় রাখার জন্য আমিষ বা প্রোটিন অপরিহার্য। এটি আমাদের পেশী তৈরি ও মেরামত করতে সাহায্য করে। এছাড়াও কোষের গঠন ও কার্যকারিতা বজায় রাখতে, হরমোন ও এনজাইম তৈরি করতে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করতে সাহায্য করে। কিন্তু যখন আমাদের শরীরে আমিষের ঘাটতি দেখা দেয়, তখন বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। যেমন,
হাড়ের ঘনত্ব কমে যাওয়া
হাড়ের ম্যাট্রিক্সের প্রধান উপাদান হল কলাজেন, যা প্রোটিন দিয়ে তৈরি। কলাজেন হাড়কে শক্তি এবং নমনীয়তা প্রদান করে। যখন আমাদের শরীরে প্রোটিনের অভাব হয়, তখন কলাজেনের উৎপাদন কমে যায়, ফলে হাড় দুর্বল হয়ে পড়ে। এছাড়াও হাড়ের কোষ, যা অস্টিওব্লাস্ট এবং অস্টিওক্লাস্ট নামে পরিচিত, সেটি ক্রমাগত হাড়ের নতুন কোষ তৈরি করে এবং পুরোনো কোষ ভেঙে ফেলে। আর আমিষ এই কোষ গুলোর বৃদ্ধি ও কার্যকারিতা নিয়ন্ত্রণ করে।
ত্বক, চুল ও নখের ক্ষতি
আমাদের ত্বক, চুল ও নখ শুধু সৌন্দর্যের প্রতীক নয়, বরং স্বাস্থ্যেরও নির্ভরযোগ্য সূচক। আর এই তিন অঙ্গের সুন্দর ও সুস্থ অবস্থা আমাদের জীবন্ত শক্তি ও আত্মবিশ্বাসের প্রতিফলন ঘটায়। কিন্তু, অনেক সময়ই আমরা বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হই, যেমন রুক্ষ ত্বক, চুল পড়া ও নখ ভেঙে যাওয়া ইত্যাদি। মূলত এই সমস্যা গুলো আমিষের ঘাটতি দ্বারা সৃষ্ট হয়।
ক্ষত দেরিতে শুকানো
আমাদের ত্বকের নমনীয়তা বজায় রাখার জন্য আমিষ, বিশেষ করে কোলাজেন, গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ত্বকের কোলাজেন তন্তু নতুন কোষ তৈরিতে সাহায্য করে এবং ক্ষতস্থানে নতুন ত্বক তৈরির প্রক্রিয়া কে ত্বরান্বিত করে। যখন আমাদের শরীরে আমিষের ঘাটতি দেখা দেয়, তখন ত্বকের নতুন কোষ তৈরির প্রক্রিয়া ধীর হয়ে যায় এবং ফলে ক্ষত দেরিতে শুকায়।
ঘন ঘন অসুস্থ হওয়া
আমাদের শরীরকে যদি একটি দুর্গ ধরা হয়, তাহলে আমিষ হল সেই দুর্গের অটুট প্রাচীর। কারণ, আমিষ আমাদের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরিতে সাহায্য করে, যা বিভিন্ন রোগজীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই করে। শুধু তাই নয়, আমিষ আমাদের কোষ গুলোকে মেরামত ও পুনর্নির্মাণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যখন শরীরে আমিষের ঘাটতি দেখা দেয়, তখন এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে এবং আমরা সহজেই অসুস্থ হয়ে পড়ি।
বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন ও উত্তর
আমিষ জাতীয় খাবার কি কি -তা নিয়ে আপনার মনে আরো অনেক প্রশ্ন থাকতে পারে। তাই নিচে কিছু প্রশ্ন ও উত্তর দেওয়া হলো। যা থেকে আপনি আমিষ সম্পর্কে আরো অজানা বিষয় জানতে পারবেন।
আমিষ জাতীয় খাবার বেশি খেলে কি হয়?
অতিরিক্ত আমিষ গ্রহণ করলে বৃক্কের উপর চাপ বেড়ে যায়, দীর্ঘমেয়াদে বৃক্কের কার্যক্ষমতা কমিয়ে ফেলতে পারে। এছাড়াও হাড়ের ঘনত্ব হ্রাস, পাচনতন্ত্রের সমস্যা সহো অন্যান্য অন্যান্য সম্ভাব্য ঝুঁকি তৈরি হয়। তাই অবশ্যই পরিমিত পরিমানে আমিষ খাওয়ার চেষ্টা করবেন।
আমিষ এর অপর নাম কি?
পুষ্টিবিজ্ঞানে আমিষভোজীদের 'সর্বভুক' বলা হয়। কারণ তারা উদ্ভিজ্জ ও প্রাণী উভয় খাবারই খায়।
উপসংহার-
আমিষ জাতীয় খাবার কি কি সেগুলো নিয়ে আজকের আর্টিকেলে বিস্তারিত বলা হয়েছে। যে আর্টিকেল থেকে আপনি আমিষ সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় জানতে পারবেন। এছাড়াও আপনার জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য কিডনি রোগী কি কি ফল খেতে পারবে ও এলার্জি হলে কি কি খাওয়া নিষেধ নিয়ে লেখা আর্টিকেল গুলো পড়তে পারেন। ধন্যবাদ।